Ad Code

ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবস কি? ভারতীয়রা কেন প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে এবং ভারতীয়রা কিভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে?

ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবস কি? ভারতীয়রা কেন প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে?

ভারতে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিনটি ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১৯৫০ সালের এই দিনে ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল, যা দেশকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ও প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি স্বাধীন ভারতের শাসন ব্যবস্থার নতুন যুগের সূচনা করেছিল। নিচে এর বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরা হলো:


পটভূমি ও গুরুত্ব

  1. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন:
    বহু বছরের সংগ্রামের পর ভারত ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতার সময় ভারতের নিজস্ব কোনো সংবিধান ছিল না। সেই সময় দেশ শাসিত হতো Government of India Act, 1935 এর অধীনে, যা ব্রিটিশদের তৈরি করা একটি আইনি কাঠামো।

  2. সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা:
    স্বাধীন ভারতকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি সুসংহত সংবিধানের প্রয়োজন ছিল, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা, অধিকার এবং সমতাভিত্তিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত করবে। এর মাধ্যমে দেশের শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং জনগণের জন্য কার্যকর করা সম্ভব হয়।

সংবিধান রচনা প্রক্রিয়া

  1. গঠনসভা (Constituent Assembly):
    ১৯৪৬ সালে গঠনসভা গঠিত হয়, যেখানে ভারতের প্রদেশগুলি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই গঠনসভার খসড়া কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর

  2. সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ:

    • ভারতের সংবিধান রচনা করতে মোট ২ বছর, ১১ মাস, এবং ১৮ দিন সময় লেগেছিল।
    • ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ তারিখে গঠনসভা সংবিধানটি গ্রহণ করে। এই দিনটি বর্তমানে সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়।
    • তবে সংবিধানটি কার্যকর করার জন্য ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ দিনটি বেছে নেওয়া হয়, কারণ এই দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল।

২৬ জানুয়ারি কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল?

  1. ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
    ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি, লাহোর অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ (সম্পূর্ণ স্বাধীনতা) ঘোষণা করেছিল। এর পর থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ভারতের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

  2. প্রতীকী ধারাবাহিকতা:
    স্বাধীনতার পর সংবিধান কার্যকর করার জন্য এই দিনটি বেছে নিয়ে ভারতের নেতা ও জনগণ স্বাধীনতার চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

প্রজাতন্ত্র দিবস – প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

  1. ক্ষমতার রূপান্তর:
    ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হলে, Government of India Act, 1935 বাতিল হয়। ভারত একটি প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে এবং ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

  2. প্রজাতন্ত্রের গুরুত্ব:
    প্রজাতন্ত্রের অর্থ হলো একটি রাষ্ট্র যেখানে প্রধান শাসক নির্বাচিত হন, উত্তরাধিকারসূত্রে নয়। এর মাধ্যমে ভারত প্রকৃতপক্ষে জনগণের দ্বারা পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন

  1. প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস:
    প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করা হয়েছিল ১৯৫০ সালে, এবং এর প্রধান অনুষ্ঠান হয়েছিল দিল্লির ইরউইন স্টেডিয়ামে (বর্তমানে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম)।

  2. আধুনিক উদযাপন:

    • আজকের দিনে, রাজপথে (বর্তমানে কর্তব্যপথ) অনুষ্ঠিত বিশাল প্যারেড প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান আকর্ষণ। এতে ভারতের সামরিক শক্তি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রদর্শিত হয়।
    • রাষ্ট্রপতি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ, এবং আধাসামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করেন।
    • এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের ট্যাবলো, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, এবং বায়ুসেনার বিমান প্রদর্শনী এই উৎসবের অংশ।
  3. বিদেশি অতিথি:
    প্রতি বছর, একটি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতি গুরুত্বের প্রতীক।

  4. বিটিং রিট্রিট:
    ২৯ জানুয়ারি দিনটি বিটিং রিট্রিট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপন শেষ হয়। এতে সামরিক ব্যান্ড দেশপ্রেমমূলক সুর বাজায় এবং জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে নামানো হয়।

প্রজাতন্ত্র দিবসের তাৎপর্য

প্রজাতন্ত্র দিবস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি, সংবিধানের মূল্যবোধ, এবং জাতির ঐক্যের প্রতীক। এই দিনটি ভারতবাসীকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে।

 ভারতীয়রা কিভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উৎযাপন করে?


ভারতে ২৬ জানুয়ারি দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এটি ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন (১৯৫০) এবং দেশকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মরণে উদযাপন করা হয়। এই দিনটি সারা দেশে বিভিন্ন আয়োজনে পালিত হয়।

জাতীয় পর্যায়ের উদযাপন

  1. দিল্লির কেন্দ্রীয় প্যারেড (কর্তব্যপথ):

    • দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান আকর্ষণ হলো কর্তব্যপথে প্যারেড, যা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে হয়।
    • রাষ্ট্রপতি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ও অন্যান্য দলের প্যারেডের সালাম গ্রহণ করেন।
    • প্যারেডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
      • সামরিক শক্তি প্রদর্শন: ট্যাংক, মিসাইল, ও বিমানসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শনী।
      • রাজ্যের ট্যাবলো: বিভিন্ন রাজ্য তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ট্যাবলোর মাধ্যমে উপস্থাপন করে।
      • শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা: স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা দেশপ্রেমমূলক নাচ ও গান পরিবেশন করে।
      • বিমান বাহিনীর উড়ান: ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইপাস্ট প্যারেডের শেষ আকর্ষণ।
    • প্রতি বছর একজন বিদেশি রাষ্ট্রনেতাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে।
  2. বিটিং রিট্রিট অনুষ্ঠান:

    • ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ভবনে বিটিং রিট্রিট অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
    • সামরিক ব্যান্ড দেশাত্মবোধক সুর বাজায় এবং জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে নামানো হয়।

রাজ্য পর্যায়ের উদযাপন

  1. পতাকা উত্তোলন ও প্যারেড:
    • প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে রাজ্যপাল পতাকা উত্তোলন করেন।
    • স্থানীয় পুলিশ, স্কুল, ও বিভিন্ন সংগঠন প্যারেড ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

স্কুল ও কলেজে উদযাপন

  1. পতাকা উত্তোলন:

    • বিদ্যালয় ও কলেজে পতাকা উত্তোলনের পর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।
    • শিক্ষার্থীরা বন্দে মাতরম, সারে জাহাঁ সে আচ্ছা-সহ দেশপ্রেমমূলক গান পরিবেশন করে।
  2. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান:

    • দেশপ্রেমমূলক নৃত্য, নাটক, ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
    • প্রজাতন্ত্র দিবসের গুরুত্ব নিয়ে প্রবন্ধ রচনা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়।
  3. প্যারেড ও কুচকাওয়াজ:

    • শিক্ষার্থীরা প্যারেড ও কুচকাওয়াজে অংশ নেয়, যা শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমের প্রতীক।

স্থানীয় ও সামাজিক উদযাপন

  1. জনসাধারণের পতাকা উত্তোলন:

    • স্থানীয় ক্লাব, আবাসিক এলাকা, ও সামাজিক সংগঠন পতাকা উত্তোলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
  2. মিষ্টি বিতরণ:

    • পতাকা উত্তোলনের পর মিষ্টি বিতরণ করা হয়, যা বিশেষ করে স্কুল ও সামাজিক জমায়েতে প্রচলিত।

পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান

  1. জাতীয় পুরস্কার:

    • পদ্ম পুরস্কার, যা ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান, প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ঘোষণা করা হয়।
    • বীরত্ব পুরস্কার (যেমন: পরমবীর চক্র, অশোক চক্র) সাহসিকতার জন্য সেনাবাহিনী ও সাধারণ নাগরিকদের প্রদান করা হয়।
  2. শিশুদের সাহসিকতার পুরস্কার:

    • জাতীয় সাহসিকতা পুরস্কার সাহসী শিশুদের দেওয়া হয়, যারা নিজেদের বীরত্ব ও সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছে।

দেশপ্রেমের প্রদর্শনী

  1. সাজসজ্জা:

    • বাড়ি, রাস্তা, এবং ভবনগুলো ত্রিবর্ণ (তিরঙ্গা) পতাকা ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়।
  2. মিডিয়া ও বিনোদন:

    • টিভি চ্যানেলে লাইভ প্যারেড সম্প্রচার এবং দেশাত্মবোধক সিনেমা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
  3. সোশ্যাল মিডিয়া:

    • লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশপ্রেমমূলক বার্তা, ছবি, ও ভিডিও শেয়ার করে।

সামরিক ও জনসাধারণের অনুষ্ঠান

  1. যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন:

    • ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল-এ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
  2. জনগণের অংশগ্রহণ:

    • মানুষ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়, ঘুড়ি উড়ায়, ও সমাজকল্যাণমূলক কাজের আয়োজন করে।

উপসংহার

প্রজাতন্ত্র দিবস কেবল একটি উৎসব নয়, এটি ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ঐক্য, এবং সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। এই দিনটি ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম, ঐক্য, এবং উন্নতির প্রতিশ্রুতি জাগ্রত করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Close Menu