বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটে চলেছে। এক রিপোর্টে দেখা গেছে “বাংলাদেশে 15-29 বছর বয়সী তরুণদের প্রায় 82 শতাংশ অন্য দেশে স্থায়ী হতে আগ্রহী। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না। কিন্তু ব্যাপার যদি এমন হয় বাংলাদেশের হত্তা-কর্তার এক রকম আমাদের বিদেশে যেতে বাধ্য করছে। এদেশের শাসন ব্যবস্থায় বসে থাকা ব্যক্তিরা কোন ভাবেই চান না যে মেধাবীরা এদেশে থেকে যাক। কি অবাক হচ্ছেন? দাঁড়ান আপনাদের খুলেই বলি ব্যাপারটা...

দেশ থেকে মেধাবী মানুষগুলো দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াটা নিছক কাকতালীয় ব্যাপার নয়। বরং একটি শীতল কৌশল। ভিন্ন মতকে দমন, স্বাভাবিক প্রতিবাদকে রোধ করা, দূনীতিবাজ শাসকের শাসনকে স্থায়ী করার জন্য “BRAIN DRAIN" একটি কার্যকর কৌশল। তবে সবদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সত্য কথাটি সত্য নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্খা দায়ী থাকতে পারে। উন্নত জীবন যাবনের আশা করা তো খারাপ কিছু না। অনেক আগে থেকেই কাজের সন্ধানে বাংলাদেশীরা পাড়ি জমিয়ে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে। দেশকে সমৃদ্ধ করছে রেমিট্যান্স দিয়ে। তাহলে উদ্দ্যেমী তরুণ-তরুণীরা বাইরে পড়তে গেলে সমস্যাটা কোথায়? আপাতত দৃষ্টিতে এটি কোন সমস্যা নয়। তবে পরোক্ষ ভাবে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। আর এই সমস্যাটা তখন প্রখর হয়ে যায় যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে দেশের তরুণ তরুণীরা দেখানেই স্থায়ী হয়ে যায়, আর দেশে ফিরে আসে না। আপনাদেরকে একটি মজার কথা বলি? আপনি কি জানেন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো Hiddenly কেন “BRAIN DRAIN" কে উৎসাহিত করে? কারণ দূণীতি গ্রস্থ শাসকেরা নিশ্চিন্ত হয়ে চায় তাদের থ্রেট করার মতো কমিউনিটি যে কোন ভাবেই বিকাশিত হতে না পারে। “BRAIN DRAIN" এর তালিকা রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার সহ দেশের নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। তাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মালেয়শিয়া, অষ্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলো। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশের পাড়ি দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হু ‍হু করে বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক “BRAIN DRAIN" এর ইনডেক্স তথ্য মতে, নিজ দেশ থেকে বাইরের দেশের পাড়ি জমানো জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান 31 তম। এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্থ ইরাক-ইয়েমেনের থেকে বেশি সংখ্যক শিক্ষিত জনসংখ্যা দেশ ছাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো বলেছে, “প্রতি বছর বাংলাদেশথেকে 70 থেকে 90 হাজার শিক্ষার্থী পাড়ি জমায় ভিনদেশে”। 2020-21 সালের তথ্য মতে বাংলাদেশে থেকে 57টি দেশে পাড়ি জমিয়েছে 50 হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। আর গেলেও কেন ফিরে ফিরে আসছে না?এই দেশ ত্যাগের ভার কি সম্পূর্ণ তাদের ঘাড়ে চাপানো যায়? যে সব কারণে এক দেশের তরুণ তরুণীরা অন্য দেশের পাড়ি জমায় তাকে বলে “পু্শ ফ্যাক্টর”। এর মধ্যে রয়েছে বিষয়ভিত্তিক কাজের অপ্রতিকুলতা, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার সুযোগের অভাব, ক্রম হ্রাসমান জীবন যাত্রার মান, এছাড়া আমাদের দেশে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য, যানজট, দূনীতি ও প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা দ্রব্য মূল্যের দাম। শুধু মাত্র তরুণ-তরুণীরাই নয় দেশে কয়েক বছর চাকুরী করেও দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকেই। তার অন্যতম কারণ হলো যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না করা। দেশের যাচ্ছে কোম্পানির সবচেয়ে দক্ষ, কর্মঠ ও পরিশ্রমী কর্মী হয়েও সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। এমনকি পাচ্ছে না চাকুরীর নিশ্চয়তা। অন্যদিকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি গুলো ক্ষমতা, প্রভাব, স্বজনপ্রীতির জোরে জায়গা করে নিচ্ছে বড় বড় পদে। সাথে পাচ্ছে মোটা অংকের পারিশ্রমিক। আবার এই দেশে ব্যবসা করতে গেলেও রয়েছে বিভিন্ন সমস্যা। কোথাও বিনিয়োগ করতে গেলে সম্মুখীন হতে হয় চাঁদাবাজি বা সিন্ডিকেটের মতো সমস্যার। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। 


 

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় 400 শিক্ষক গত 30 বছরে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসে নাই। দেশের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও চিত্রটা এমনই। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আল্টিমেট উদ্দ্যেশ্যেই থাকে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার জন্য বাইরে যাওয়া এবং সুযোগ বুঝে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যাওয়া। আর নিয়োগ পরীক্ষায় যে পরিমাণ দূনীতি চলে তাতে আর একটি প্রতিবেদন লেখা যাবে। ‍বিভিন্ন ইনডেক্সে উঠে এসেছে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। আমাদের প্রিয় রাজধানী শহর ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দুষিত শহরের তালিকা 2য়। অন্য দিকে ওয়াল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স-এ বিশ্বের 137টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান 118 তম। মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের 191টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান 129 তম। কোন সূচকেই কোন রকম আশানূরূপ অবস্থানে নেই এই বাংলাদেশ। শিক্ষা ও গবেষনাতে একদম তলানীর দেশ বাংলাদেশ। এমনকি এশিয়ার শীর্ষে 100টি ইউনিভার্সির তালিকায় নেই বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের নামও। মূলত এই দেশ থেকে এক রকম পালিয়ে যাচ্ছে তারা। এসব অসুবিধার বিপরীতে বিদেশে তারা অনেক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। এক বলে Pull Factor। যেমন উন্নত জীবনযাপন, নিজ ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছান্দ্য, উন্নত পরিবেশের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলার সুব্যবস্থা। কিন্তু কথা হচ্ছে বিশ্বের অনাবিল সুযোগ সুবিধার বিপরীতে দেশে কেন দিনের পর দিন অব্যবস্থাপনায় বহাল থাকছে? 

যেসকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদেশের পাড়ি জমাচ্ছে তাদের পিছনে অনেক টাকা খরচ করেছে সরকার। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক শ্রেনীর শিক্ষার্থীর পিছনে সরকারের ব্যয় প্রায় 5 লক্ষ টাকা। বুয়েট শিক্ষার্থীর পিছনে ব্যয় প্রায় 10 লক্ষ টাকারও বেশি। মেডিকেল স্টুডেন্টের ক্ষেত্রে সেটি 15 লক্ষ টাকাও বেশি। কিন্তু এই বুয়েট ও মেডিকেলে প্রতি ব্যাচ থেকে দেখা যায় 40 থেকে 50 শতাংশ শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যায়। আর যারা যায় তারা আর ফিরে আসে না। কিন্তু কেন? দেশ প্রেমের অভাব? এভাবে মেধা পাচার হতে থাকলে একদিন দেশতো মেধা শূন্য জাতিতে পরিণত হবে। সেটাকি ভাবছে না কেউ?এক টুইট বর্তায় এলোন মাক্স বলেছিলেন “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” চলছে ভারতীয়দের মস্তিষ্কে। 

 আর এই কথা বলার মূল কারণ হলো আমেরিকার জায়ান্ট কোম্পানির গুলো বেশি ভাগেরই CEO মুকুট পড়ে আছে ভারতীয় বংশোদ্ভুতরাই। যেমন ধরুন Sundar Pichai যদি গুগোলের মুল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের CEO, আবার Satya Nadella যিনি Microsoft এর সিইও। এগুলো আপাতত দৃষ্টিতে ভারতীয়দের প্রাপ্তি বলে মনে হলেও আসলে না। হয়তো দেশে সঠিক মতো কাজের ক্ষেত্র ও পারিশ্রমিক না পাওয়ার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন ভীন দেশে। Great India Brain Drain এর পর ভারত এখন ব্রেইন গেইন এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু বিশেষ পদক্ষেপও নিয়েছে তারা। ভারত সরকার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও আইটি বিশেষজ্ঞদের দেশের ফিরিয়ে আনার দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। এবং এই সেক্টেরের জন্য Bengalur কে এশিয়ার সিলিকন ভ্যালী হিসাবে বিকাশিত করছে। বিশ্বের সবচেয়ে মেধা পাচার হয় চিন থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেধাবী চীনাদেরকে দেশে ফেরানোর জন্য মেগা প্রজেক্টের ঘোষনা দিয়েছিল চীন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে হলেও দেশের স্বার্থে তাদেরকে ফিরে আসার আহব্বান জানিয়েছিলো দেশটি। চীন সরকারের দেওয়া তথ্য মতে 2017 সাল পর্যন্ত অন্তত 6,000 জন এই আহব্বানে সাড়া দিয়ে নিজ দেশে ফিরে এসেছেন। দক্ষিণ কোরিয়া 2017 সালে 500 জন বাছাই কৃত কোরিয়ানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করিয়ে ছিল। অথচ আমাদের দেশের অবস্থা এর পুরাপুরি উল্টো। 2013 সালের একটা ঘটনা বলি। হতাশা আর বঞ্চনার স্বীকার হয়ে বাংলাদেশের ধান গবেষনা ইস্টিটিটিউটের 115 জন বিজ্ঞানীকে চাকুরী ছেড়ে দিতে এক রকম বাধ্য করা হয়েছিল। এটি কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। এরকম অবস্থা দেশের সব ক্ষেত্রে। কেউ যদি দেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ হয়ে ফিরেও আসে তাকে হেনস্থা করা হয়। আর এই হেনস্থা করা হয় রাজনৈতিক প্ররোচনায়। সুবিধাভোগীদের বিশেষ স্বার্থ রক্ষার জন্য। 

একটা কথা কি আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন? একটা মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে নিজের দেশ নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, নিজের আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফেলে অন্যের দেশ, বাড়ি বা ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেশের সন্তানদের দেশের ফিরিয়ে আনার জন্য কোন উদ্যোগ কি আদেও কি নিয়েছে আমাদের কর্তারা?সে আমার জানা নেই। যদি কারও জানা থাকে অবশ্যই নিচেই কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ।