গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ঢাকা জীবনের ছা পোষা জীবন। বাবা মায়ের হা বিদ্বেষ “চাকুরী বাকুরী আর হবে না নাকি খোকা?” খোকার চোখের ফোটা ফোটা বৃষ্টি মোটা মোটা বইয়ের পাতা ভিজে য়ায়। এসব অংকের চেয়ে জটিল জটিল সমস্যা মিলিয়ে তাকে জিততে হবে। প্রশ্নফাসঁ, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ দূনীতি আর সর্বশেষ 56% কোটার হিসাব মিলিয়ে তাকে টিকে থাকতে হবে। খোকা কাকে বোঝাবে? এই দেশে তার মেধার কোন দাম নেই। তার কৃষক বাবার পরিশ্রমের কোন মূল্য নেই। এতদিনে অর্জিত সার্টিফিকের কাগজের মূল্য নেই কোন মহাজনের কাছে। কোথায় যাবে খোকা? বয়স হওয়ার আগে বয়স শেষ হওয়ার দূর্বিষহ তাড়া। 

বাংলাদেশের তুরণ সমাজের একমাত্র ভরসার জায়গার ছিল Bangladesh Public Service Commision(BPSC)। সেখান থেকে এখন প্রশ্ন ফাসঁ হয়। BCS এর স্বপ্ন বিভোর তরুন একদিন সকাল ঘুম থেকে BCS এর প্রশ্ন নাকি ফাঁস হয়েছে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত পড়তে পড়তে পিঠ বাঁকা করতে ফেলা কোথায় যাবে এই তরুন। কি করবে? কোথায় যাবে সার্টিফিকেট পোষা লক্ষ লক্ষ বেকার শিক্ষিত বেকার?

তরুন প্রজন্মকে যে কয়টি আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি অতি সরব হতে দেখা গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি কোটা বিরোধী বা কোটা সংস্কার আন্দোলন। 2018 সালের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার 3য় ও 4র্থ শ্রেণিতে কোটা বহাল রেখে এবং 1ম ও 2য় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে। 2018 সালে বিষম্য মুলক কোটা বাতিলে পরিপত্রের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়। তিন বছর পর আদালত এখন খোদ কোটা বাতিলে ফরমান খারিজ করে দিলেন। ছাত্রদের বাধ্য আবার রাজপথে নামতে হলো। শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো হলো আদালতের সামনে। মুক্তিযোদ্ধা কোট বহাল রেখে অপমান করা হলো খোদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই।

দিলু রোড। সম্প্রতি স্যোসাল মিডিয়া কাপাঁনো একটি রোড। কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে দিলু রোড নিয়ে ট্রল শুরু হয়। কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে দিলু রোড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক নারীর রাইফেল হাতে তোলা একটি ছবি দিয়েছিল। 1971 সালে তিনি দিলু রোডে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিয়েছিলেন। 


তার পরেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলতে থাকে রাইফেল হাতে নিয়ে ছবি তোলা ঐ নারী কোনো ভাবেই মুক্তিযোদ্ধা নন। এই আক্রোশ আসলে মনসতাত্ত্বিক। গত কয়েক বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে এমন ভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা বা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সরাসরি কথা বলা যায় না বলে ভিন্নভাবে দিলু রোড নিয়ে এত ট্রল হয়েছে।তরুন সমাজের এই বিরোধ আসলে আমাদের দেশের চলমান সিম্টেমের প্রতি। তারা রাষ্ট্রের সাথে আর তাদের অধিকার নিয়ে আপোষ করতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের সুচনা হয়েছিল যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেই বৈষম্য তারা ভেঙে দিতে চায়। অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সূর্য সন্তান। এদেশের নরম পলি মাটির সাথে মিশে আছে তাদের রক্ত। তাদের ঋণ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্বাধীনতার পর থেকে চালু ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। প্রথম প্রজন্ম কোটা ব্যবহার করে ভালো অবস্থান তৈরি করলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কোটা ব্যবহারে যৌক্তিকতা কোথায়? 

সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর 1972 থেকে 1976 সালে পর্যন্ত 20 শতাংশের ভিত্তিতে নিয়াগ করা হতো। বাকি 80% পদের কোটায় নিয়োগ হতো।  1976 সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ 40% বাড়ানো হয়। 1985 সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে 45% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি 55 শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে 30% মুক্তিযোদ্ধা, 10% নারী, 10% জেলা কোটা ও 5% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পরে 1 শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পুরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় 56%। 

শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়। এই কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসা বা বহাল রাখা মানে মেধাবীদের 100টির মধ্যে 56টিতে অযোগ্য হয়ে যাওয়া। তাছাড়া কোটার মধ্যে বেশি ভাগ সময় যোগ্য লোক পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিবছর পদ শূন্য থেকে যায় কয়েক হাজার। অথচ আজ শিক্ষিত তরুণ-তরূণীদের ঘরে ঘরে গঞ্জনা, বাহিরে বঞ্চনা।

সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-এর 2022 সালের প্রতিবেদন মতে 

প্রায় 41 শর্তাংশ তরুন এখন নিষ্ক্রিয়।  15 থেকে 24 বছর বয়সসীমার এই নিষ্কিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় 1 কোটি 29 লাখ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের 3 ভাগের 2 ভাগই বেকার। অন্য একটি প্রতিবেদনের বলা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকৃত 47 শতাংশ শিক্ষার্থীই এখন বেকার। ভারতে এই হার মাত্র 33 শতাংশ, পাকিস্তানে 28 শতাংশ, নেপালে 20 শতাংশ আর শ্রীলংকায় মাত্র 7.8 শতাংশ। 

এই তরুণেরা তাহলে কি করবে? নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে মরবে? নাকি ভঙ্গের বঞ্চনা নিয়ে ধুকে ধুকে মরবে? অন্য দিকে সুবিধা ভোগীরা বেনজী-মতিনের মতো সরকারের ঘাড়ে বসে বানাবে দেশটাকে মগের মুল্লুক। এত এত বৈষম্যের বিপরীতে শিক্ষার্থীদের সামনে কি আর কোন পথ খোলা ছিল? ছিল না। ছিল না বলেই আজ রোদ, বৃষ্টি, পুলিশের লাঠি চার্জ ও ছাত্র লীগের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছে তারা। যার নাম দিয়েছে “বাংলা ব্লকেড”। এটাকে বাংলা অচলও বলা যেতে পারে। সারাদেশের উচ্চ শিক্ষা অঙ্গন আজ অচল। একদিকে শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন অন্যদিকে শিক্ষকদের পেনশন স্কীম বিরোধী আন্দোলন। এরশাদের পতনের পর শিক্ষা অঙ্গনে এই রকমের বড় আন্দোলন আর হয়নি। বিশেষত বাংলা ব্লকেডে সারা দেশ এখন কার্যত স্থবির। কিন্তু সরকার এখনও নিরুত্তাপ। হেঁসে খেলে উড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তারা রাস্তায় কেন? এই প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। কার্যত আজ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের পিছনে সরকারের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি। তাদেরই অপরিণামদর্ষি সিদ্ধান্তের জন্যই তাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। 

আন্দোলনকারীরা কোটা পদ্ধতির সম্পূর্ণ বাতিল চায়নি কখনও। অনাগ্রসর জাতির জন্য যৌক্তিক পর্যায়ে কোটা বহাল রেখে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিল। কিন্তু সরকার রেগে মেগে কোটা ব্যবস্থায় তুলে দিল। ফলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী, নারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিল। তখন কোটা সম্পূর্ণ বাতিল না করলে হয়ত আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আন্দোলনের তীব্রতা যখন কাপিয়ে তুলছে বাংলাদেশ তখন ছাত্র সমাজকে হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে। তাদের দাবিগুলো বিবেচনায় না দেখানো হচ্ছে আগের পুরাতন সেই গলির পথ। মনে রাখতে হবে এর নাম ছাত্র আন্দোলন। যার সামনে মাথানত করেছিল ইয়াহিয়ার স্বসস্ত্র হায়নারা। যার সামনে দুমড়ে মুচড়ে খান খান হয়ে গিয়েছিল এরশাদের স্বৈরাচারী দম্ভ। 

কোটা সম্পর্কে আপনার কোন মতামত থাকলে বা কোন কিছু সংশোধন বা সংযোজনের প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবেন।

সবশেষে কোটা আসলে কি জরুরী? কত টুকু জরুরী সে সম্পর্কে আপনার মতামত নিচে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।